মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২১ পূর্বাহ্ন

ভূমি দস্যু ‘অপ্রতিরোধ্য’ আওয়ামী ‘গডফাদার’ হাসানাত আবদুল্লাহ

রিপোর্টারের নাম / ৩৭ টাইম ভিউ
আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২১ পূর্বাহ্ন

আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু জেলা ছাড়িয়ে বরিশাল বিভাগে দলের রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। নিজের অনুসারীদের নিয়ে গড়েন একটি শক্তিশালী ক্ষমতার কেন্দ্র। দলীয় কমিটি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নকাজের বড় কমিশন আদায় এবং জমি দখলের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ১৬ বছরে বেড়েছে তাঁর সম্পদ।

স্থানীয় বাসিন্দা, ভুক্তভোগী মানুষ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে হাসানাত আবদুল্লাহ ‘বরিশালের গডফাদার’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রাজত্বে সবাই ছিল ‘করদ প্রজা’। তাঁকে টাকা না দিলে জেলায় কোনো সরকারি কাজ বাস্তবায়িত হতো না। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গণমাধ্যমও কথা বলতে ভয় পেত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হওয়ার সুবাদে তাঁকে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ‘অভিভাবক’ হিসেবে প্রচার করতেন অনুসারীরা।

আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আশির দশকের শেষ দিকে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর তিনি দীর্ঘদিন এই পদে ছিলেন। ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি জেলা সভাপতি হন। তিনি ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য হন। ২০০১ সালে তিনি পরাজিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি। এরপর ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার তিনি সংসদ সদস্য হন।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সংসদে চিফ হুইপ ছিলেন আবুল হাসানাত। চিফ হুইপ হিসেবে তাঁর যোগ্যতার প্রশ্নে সে সময় নানা আলোচনা ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ ছাড়া তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রীর পদমর্যাদা) ছিলেন। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, ভুক্তভোগী মানুষ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নেতা-কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে হাসানাত আবদুল্লাহ ‘বরিশালের গডফাদার’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রাজত্বে সবাই ছিল ‘করদ প্রজা’।

প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে কখনো নামমাত্র মূল্যে, আবার কখনো গায়ের জোরে হাসানাত আবদুল্লাহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে অনেক জমি দখল করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও তাঁর কাছে জমি হারিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পাননি।

গৌরনদী উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসানাত আবদুল্লাহর নামে উপজেলার চর গাধাতলী মৌজার জেএল-৫৫,৭০৯ নম্বর দাগে ৬৪ শতাংশ, উত্তর বিজয়পুর মৌজার জেএল-৫০,৫৪৪ নম্বর দাগে ৩০ শতাংশ, একই মৌজার জেএল-৫০,৬১৯, ৬২২,৬২৪ ও ৬১৮ নম্বর দাগে ৭০ শতাংশ এবং দক্ষিণ পালরদী মৌজার জেএল-৫৪,২৬৩, ২৫৯,২৬০, ২৬৩,২৬৪ নম্বর দাগে ৫৪ দশমিক ৭২ শতাংশ জমির রেকর্ড রয়েছে। সব জমিই ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রেকর্ড হয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হওয়ার সুবাদে তাঁকে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির ‘অভিভাবক’ হিসেবে প্রচার করতেন অনুসারীরা।

উপজেলার দক্ষিণ পালরদী গ্রামের মৃত আরশেদ আলী হাওলাদারের ছেলে ও রিকশা গ্যারেজের মিস্ত্রি নূর মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, হাসানাত আবদুল্লাহ ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে দক্ষিণ পালরদী মৌজার ১ একর ৪৮ শতাংশ জমি দখল করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেন। সেখানে নূর মোহাম্মদসহ একাধিক ব্যক্তির জমি রয়েছে। পরে গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আবুল হোসেন মোল্লা এসব জমি হাসানাতকে দলিল করে দিতে জমির মালিকদের চাপ দেন।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি ও আমার তিন বোন জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ভয়ভীতি দেখানো হয়। একপর্যায়ে আবুল মোল্লা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি প্রাণভয়ে ও আমার সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে হাসানাত আবদুল্লাহকে দলিল করে দিতে বাধ্য হই। আমার দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমি লিখে নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ আমাকে মাত্র ১৬ লাখ টাকা দিয়েছেন। ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছুই করার ছিল না। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি।’

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে অনেক জমি দখল করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও তাঁর কাছে জমি হারিয়েছেন। ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পাননি।

হাসানাতের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ‘দি লক্ষ্মণ দাস সার্কাস’-এর মালিক অরুণ দাস (৭২) অভিযোগ করেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে দক্ষিণ পালরদী মৌজার তাঁদের নির্মাণাধীন ‘লীলা সিনেমা হল’-এর জমির প্রতি হাসানাত আবদুল্লাহর দৃষ্টি পড়ে। ওই জমি দলিল করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। রাজি না হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন মোল্লা ও স্থানীয় সেলিম হাওলাদার জমি বিক্রির প্রস্তাব দিলে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

পরে হাসানাত আবদুল্লাহ প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাঁদের সার্কাসের শো বন্ধ করে দেন। এতে তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। দীর্ঘদিন সার্কাস বন্ধ থাকায় শিল্পী-কলাকুশলী ও পশু-পাখিদের খাবারের ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তখন তিনি নির্মাণাধীন ভবনসহ ৩৪ শতাংশ জমি দলিল করে দিতে বাধ্য হন। প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে মাত্র ৩৬ লাখ টাকা দিয়েছেন হাসানাত আবদুল্লাহ।

অরুণ দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখানেই শেষ না, হাসানাত আবদুল্লাহ আমার ৯৬ শতাংশ জমির ওপর থাকা দিঘি লিখে নেওয়ার জন্য পুনরায় চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু রাজি না হওয়ায় গৌরনদী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান আমাকে জীবননাশের হুমকি দেন। এরপর প্রাণভয়ে আমি গৌরনদী যাওয়া বন্ধ করে দিই।’

দলীয় নেতা-কর্মীদের জমিও দখলের অভিযোগ আছে হাসানাত আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে। দক্ষিণ পালরদী গ্রামের মৃত মুনসুর হাওলাদারের ছেলে ও পৌর যুবলীগের সদস্য ফিরোজ হাওলাদার অভিযোগ করেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে দক্ষিণ পালরদী মৌজায় তাঁদের বসতবাড়ির ৫৬ শতাংশ জমি হাসানাত আবদুল্লাহ তাঁর নামে দলিল করে দিতে চাপ দেন। রাজি না হওয়ায় লোকজন দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে উৎখাত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে বসতভিটার ৫৬ শতাংশ জমির চারপাশ দিয়ে প্রাচীর তুলে দেন।

ফিরোজ হাওলাদার বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর ধরে নিজেদের বসতভিটায় চার দেয়ালে বন্দী অবস্থায় বসবাস করছি। আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত ছিল, জীবন যাবে, তবু বসতভিটা ছাড়ব না।’

উত্তর বিজয়পুরে আরও দুই হিন্দু পরিবারের ৭০ শতাংশ জমি দলিলের মাধ্যমে দখলের অভিযোগ রয়েছে হাসানাতের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে এক চিকিৎসকের কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ জমি দলিল নিয়ে তাঁকে ১০ লাখ টাকা দেন। অপর পরিবারটির ৬০ শতাংশ জমি লিখে নেওয়া হলেও তাঁদের কত টাকা দেওয়া হয়েছে কিংবা আদৌ দেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা ভয়ে মুখ খুলছেন না।

গৌরনদীর উত্তর বিজয়পুর এলাকার মৃত ময়জুদ্দিনের নাতি আবুল হাসান অভিযোগ করেন, উত্তর বিজয়পুর মৌজায় তাঁর দাদা ময়জুদ্দিনের নামে ২৮ শতাংশ জমি রয়েছে। ২০১৯ সালে হাসানাত ওই জমি তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত আমেনা বেগম হোমিওপ্যাথিক কলেজকে রেকর্ড করে দিয়েছেন। আবুল হাসান বলেন, ‘তাঁর ক্ষমতার কাছে আমরা অসহায়। এত বড় অন্যায় নীরবে মেনে নিতে হয়েছে।’

গৌরনদী মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি পাঠাগারের নাম করে অন্যের ৩০ শতাংশ জমি হাসানাতের নামে রেকর্ড করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড সুপারমার্কেটের ছয়জন ব্যবসায়ী বলেন, গৌরনদী মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি পাঠাগারের জমির সামান্য কিছু অংশ তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে পড়েছে। হাসানাত পাঠাগারের জমি নিজের নামে রেকর্ড করে নেওয়ার পর ২০১৫ সালে তা নিজের জমি বলে দাবি করেন। এ জমি ব্যবসায়ীদের লিখে দেবেন জানিয়ে মূল্য দাবি করেন হাসানাত আবদুল্লাহ। পরে আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন মোল্লার মধ্যস্থতায় ব্যবসায়ীরা মিলে ৭০ লাখ টাকা হাসানাতকে দেন। কিন্তু টাকা নিয়েও তিনি জমি দলিল করে দেননি।

জোর করে অন্যের জমি লিখে নিয়ে তা সরকারের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ আছে হাসানাতের বিরুদ্ধে। গৌরনদীর চাঁদশী ঈশ্বর চন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজী জামান বলেন, ২০১৪ সালের নভেম্বরে তাঁর বাবা মোখলেছুর রহমানকে ধরে নিয়ে চরগাধাতলী মৌজার ১০ শতাংশ জমি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের নামে জোরপূর্বক দলিল করিয়ে নেন হাসানাত আবদুল্লাহ। এ ঘটনার পর তাঁর (কাজী জামান) বাবা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন এবং ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি মারা যান। হাসানাত আবদুল্লাহ তাঁর বাবার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে কবর বাঁধাই করতে বলেন।

কাজী জামান বলেন, ‘শুনেছি, পরে ওই জমি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে অধিগ্রহণের মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নেন হাসানাত আবদুল্লাহ। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রশাসনকে ব্যবহার করে হাসানাত আবদুল্লাহ ওই মৌজায় আমাদের আরও ৬৪ শতাংশ জমিতে দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়েছেন।’

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন মোল্লা ও ছাত্রলীগ নেতা লুৎফর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *